সুপার হোস্টেল: ব্যাচেলরদের আনন্দ ভুবন | Super Hostel: A world of bachelor joy

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপলব্ধি করেছিলেন, “তেরো-চৌদ্দ বৎসরের ছেলের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই।” কথাটা যেন বাংলাদেশের ব্যাচেলর নামের প্রজাতির ক্ষেত্রে সমান খেটে যায়। ‘প্রজাতি’ বলার কারণ হচ্ছে আমরা ব্যাচেলরদেরকে ঠিক যেন মানুষ ভাবতে পারি না।

ক্রমবর্ধিষ্ণু মেগাসিটি পোকামাকড়ের মতো মানুষের ভিড়ে ব্যাচেলররা আরও ব্রাত্য। ঢাকা নামের এই নগরে ব্যাচেলরদের হাহাকার অজস্র কোলাহলে ঢাকা-ই পড়ে থাকে। “ব্যাচেলরদেরকে ভাড়া দেয়া হয় না” লেখা নোটিস ঝোলে বাড়িতে বাড়িতে। আর যারা একটু ‘উদার(!)’ তারা যেন ভাড়া দিয়ে একদম উদ্ধার করে ফেলেন।

সজীব বাকের মহাখালীর দক্ষিণ পাড়ায় একটা মেসে থাকেন। “ভাই, বিশ্বাস করবেন না কী অবস্থায় আমরা থাকি! পরের দিন পরীক্ষা, অথচ রাত এগারোটায় রুমের বাতি বন্ধ করে দিতেই হবে। বারান্দা বা জানালা থেকে বাইরে বা ওপরের দিকে তাকানো যাবে না। আরও যে কতো বিধিনিষেধ!

“ফ্ল্যাটে নানান সমস্যা, কিন্তু বাড়িয়ালাকে কিচ্ছু বলা যাবে না, নিজেদেরকেই সবকিছুর সমাধান করতে হবে। ওনার একমাত্র দায়িত্ব কেবল মাস শেষে আমাদের কাছ থেকে ভাড়া নেয়া,” অসহায় হাসলেন তিতুমীর কলেজের ছাত্র সজীব।

‘মেস’ নামের এক জায়গায় এরা থাকে যেটাকে বাসস্থান ছাড়া আর যে কোনও নামে ডাকা যায়। মানবেতর জীবনের চেয়ে কোন অংশে কম এই শহরের মেসগুলো?

চীনের দুই নাগরিক নেলসন ঝাং আর জিমি ঝাংকে এই ব্যাপারটা ধাক্কা দিয়েছিলো। “আমি ২০১৪ র অগাস্টের দিকে বাংলাদেশে আসি। তখন নেলসনের প্রতিষ্ঠানে জনাদশেক স্থানীয় লোক কাজ করতেন। ওদের মধ্যে সিংহভাগই ঢাকার বিভিন্ন মেসে থাকতেন। কয়েকটায় গিয়ে দেখলাম কী নোংরা পরিবেশে ওরা থাকেন!” জিমি বলছিলেন।

“ঘরগুলো নোংরা, পুরো জায়গাটা অগোছালো, টয়লেটে দুর্গন্ধ… মানুষের থাকার জন্য মোটেও ভালো ব্যবস্থা নয়। কৌতূহল-বশে আরও কিছু মেস আর হোস্টেলে ঘুরলাম, যেখানকার পরিবেশ কমবেশি একই রকম। কী ছাত্র, কী চাকুরে, নারীই হোন বা পুরুষ – ব্যাচেলর বা অবিবাহিতদের যেন এটাই নিয়তি! গুগল ঘেঁটে জানা গেল, ঢাকায় কমসেকম ৩০ থেকে ৪০ লাখ ব্যাচেলর কমবেশি এই মানের বাড়িঘরেই থাকেন।”

“এই যে তরুণেরা- ওরাই তো দেশের ভবিষ্যৎ,” গুয়াংদং ইউনিভার্সিটি অভ টেকনোলজির হার্ডওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক বললেন। “একজন তরুণ যদি বাসা পেতে চায় তাকে জিজ্ঞেস করা হয় তিনি বিবাহিত কি না। না হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা বাড়ি পান না। কিন্তু বিয়ের আগে কে কবে ব্যাচেলর ছিলো না! এমনকি যিনি এই প্রশ্ন করেন তিনিও তো একদিন ব্যাচেলরই ছিলেন, তাই না? তার মানে তো আর এই নয় যে ব্যাচেলর মানেই খারাপ লোক! তো এই জায়গাটায়ই আমরা হাত দিলাম।”

দুই বাল্যবন্ধু তখনই নেমে পড়লেন জনসংখ্যার বিচারে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্রমবর্ধিষ্ণু শহরের অন্যতম অবহেলিত বর্গটির জন্য। নিউওয়েইজ ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আর মূখ্য পরিচালন কর্মকর্তা মিলে গড়লেন সুপার হোস্টেল। ব্যাচেলরদের জন্য অভাবনীয় সব সুবিধা নিয়ে ২০১৭ সালের অক্টোবর উত্তরায় যাত্রা শুরু করলো বিশ্বমানের আবাসনব্যবস্থা। এরপর মিরপুরে দু’টো (যার একটা আবার শুধুই নারীদের জন্য) বারিধারা, বাড্ডা আর শাহবাগে গত দুই বছরে গড়ে উঠেছে আরও পাঁচটি।

ঘুরে দেখা গেলো, মোট ছ’টি হোস্টেলের প্রতিটিতেই রয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিলাসবহুল লবি আর মাল্টিফাংশনাল বেডসম্বলিত শোবার ঘর। “আমাদের লবিগুলো দেখুন, যেন ছিমছাম, মনকাড়া একটা কফি শপ,” তৃপ্তির হাসি জিমির মুখে।

তার মতে, “একজন ব্যাচেলরের জীবনে যা কিছু একান্ত প্রয়োজনীয় তার সবকিছুরই যোগান দেয়া হয় এখানে। বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে যে কেউ শুধুই নিজের কাপড়চোপড় নিয়ে চলে আসুন, বাকি সমস্ত কিছু… বিছানা, বালিশ, চাদর, ব্যক্তিগত লকার, ফোন চার্জার এমনকি শ্যাম্পু-সাবানও প্রস্তুত তার জন্য!”

পরিচ্ছন্ন রান্নাঘর থেকে সদস্যদের জন্য আসে তিন বেলার গরমাগরম খাবার। সঙ্গে ওয়াশিং মেশিন আর বৈদ্যুতিক ড্রায়ার, ২৪ ঘণ্টা নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাব্যবস্থা, বায়োমেট্রিক প্রবেশ, ছাদে ক্রিকেট, ফুটবল খেলার জায়গা যেখানে রয়েছে বৈচিত্র্যময় ক্রীড়া সরঞ্জাম। এতোগুলো সেবার জন্য সুপার হোস্টেলের স্ট্যান্ডার্ড ক্লাসের একজন সদস্যের দৈনিক খরচ পড়ে মাত্র ২৩৩ টাকা! তুলনামূলক গুরুত্বপূর্ণ বা অভিজাত এলাকায় বাড়তি কিছু সুবিধাসম্বলিত, যেমন লিফট, বিজনেস ক্লাস হলে ২৬৬।

সুপার হোস্টেলের দর্শন সীমিত সম্পদ দিয়ে যতো বেশি সম্ভব মানুষকে একসঙ্গে সেবা দেয়া, জিমি জানালেন। “কৃষিভিত্তিক সমাজে আগে একজন মানুষকে তার জীবনযাপনের প্রায় সকল উপকরণ নিজেকেই যোগাড় বা উৎপাদন করতে হত। কিন্তু আজকের শিল্প যুগের বাস্তবতায় একজন ব্যক্তির নিজের কাপড় বা জুতো বানানো কিংবা খাবার উৎপাদনের অবকাশ নেই। তবু সাধারণ কর্মব্যস্ত মানুষকে আজও নিজের রান্না, কাপড় ধোয়া, ঘর পরিষ্কারের মতো নানান কাজগুলো করতেই হয় বা অন্যের ওপর নির্ভর করতে হয়।

“কিন্তু পেশাদার সেবাদাতারা সুপার হোস্টেলের সদস্যদেরকে সকল প্রাত্যহিক কাজ থেকে পুরোপুরি মুক্তি দিচ্ছে। এতে করে ব্যাচেলরদের সময়, ঝুট-ঝামেলা, হয়রানি, পরিশ্রম বেঁচে যাচ্ছে। আর তাই তারা তাদের কাজে বেশি সময় দিয়ে নিজেদেরকে আরও বেশি শাণিত করে তুলতে পারেন। এভাবে পুরো সমাজই আরও বেশি দক্ষ হয়ে উঠতে পারে। আমরা সমাজের সমস্যার সমাধান করতে চাই। এটাই আমাদের দর্শন।”

কেবল প্রাত্যহিক কাজকর্মই নয়, এখানকার সদস্যরা মুক্ত অনেক অনাহুত বিপদআপদ থেকেও। টাঙ্গাইলের মওদুদ আহমেদ ঢাকার মোটামুটি নামকরা কলেজ ছেড়ে দিয়েছিলেন এমনই এক উটকো ঝামেলা থেকে। “অনেক ছাত্র কলেজ হোস্টেলেই বেশ খোলাখুলি মাদক নিতো। বিকল্প খুঁজতে গিয়ে সুপার হোস্টেল পেলাম। ছাত্র হিসেবে আমি বলবো এমন পরিবেশ ঢাকায় আর কোথায়ও নেই।”

মাত্র চারজন চীনা নাগরিক সুপার হোস্টেলের বাকি সকল কর্মীই বাঙালি। “আমাদের প্রতিষ্ঠান ক্রমশই দ্রুতগতিতে বড় হচ্ছে। এতে করে বহু লোকের কর্মসংস্থানও হতে থাকবে।” জিমির বিশ্বাস, “পুরো প্রকল্পটাই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে খুব ছোট্ট হলেও একটা ভূমিকা রাখবে”।

জিমি ঝাং হিসেব কষে দেখালেন, বাসস্থান থেকে কর্মস্থলে আসতে-যেতে ঢাকার বেশিরভাগ নাগরিকের প্রতিদিন ঘণ্টাতিনেক সময় পথেই নষ্ট হয়ে যায়। আপনার বয়স যদি ২৪ হয়, কেবল রাস্তাতেই তিন বছর কেটে গেছে কিছু না করেই। তাহলে স্রেফ একটা মানুষের জীবনের সাড়ে ১২% অপচয় হয়ে গেলো। একবার ভাবুন তো পুরো জনসংখ্যার এই যোগফলটা দেশের জিডিপিতে যোগ করতে পারলে কী হতে পারতো! সময়ই তো আসল জিডিপি!”

তাই নিউওয়েইজের লক্ষ্য ঢাকায় ১০০টি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সুপারহোস্টেলের শাখা খোলা।

“আমরা চাই একজন ছাত্র বা কর্মজীবী যেন মাত্র পাঁচ মিনিটেই তার বাসস্থান থেকে কর্মক্ষেত্রে পৌঁছে যেতে এবং সমপরিমাণ সময় ব্যয় করে ঘরে ফিরতে পারেন,যেন কারওর জীবনের এতোগুলো বছর কেবল যাত্রাপথেই নষ্ট না হয়।ওই সময়টা তারা পরিবারের সঙ্গে অথবা শিক্ষায় বা কর্মক্ষেত্রে কাজে লাগাতে পারেন। এমনকি বিনোদন বা বিশ্রামেও মূল্যবান মুহূর্তগুলো ব্যয় করা যায়।”

জিমি ঝাংবিশ্বাস করেন তারা আসলে মানুষের জীবনকে সহজ করার চেষ্টা চালাচ্ছেন।

“তাই আমি মনে করি আমরা যেন মানুষের কল্যাণ করতে পারি সেজন্য সেজন্য একটা সহজ নীতিমালা থাকা দরকার। এ জায়গায় সরকারের সমর্থন আর সহযোগিতা খুব প্রয়োজন।”


0/Post a Comment/Comments

Previous Post Next Post