ব্যাচেলর বাসাবাড়ি | Bachelor's home


 

বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকা দেশটির সকল প্রকার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। নগরায়নের বিপ্লবে শহরটি উন্নয়নের নতুন মাত্রায় পেয়েছে। শিল্পায়নের দ্রুত বিকাশ এ শহরের বাণিজ্যিক ও ব্যবসায়িক খাতকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছে। ৯০ লক্ষের অধিক জনসংখ্যা নিয়ে একবিংশ শতকে মেগাসিটি ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহরের তালিকায় নাম লিখিয়েছে। কর্মসংস্থান এবং উন্নত জীবনের স্বপ্ন নিয়ে প্রতিনিয়ত ঢাকায় চলে আসছে অসংখ্য মানুষ। আর তাতে শহরের জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে। জরিপ অনুযায়ী, প্রতিবছর ঢাকায় নতুন করে যুক্ত হচ্ছে ৬৩০,০০০ মানুষ (প্রতিদিন ১৭০০)। আর জনসংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে বাড়ছে নানাবিধ সমস্যাও, যা শহরের মানুষের জীবনমানকে প্রভাবিত করছে। সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর একটি হলো বাসস্থান সমস্যা, যার বড় ভুক্তভোগী হলো অবিবাহিত পুরুষ বা ব্যাচেলররা।

অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণে বাসস্থানের চাহিদা এবং যোগানের মধ্যে পার্থক্য বেড়েই চলেছে। আর এ সমস্যার বড় ভুক্তভোগী হলো নিম্ন-মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারের একক নারী বা পুরুষ, যারা ঢাকায় আসেন চাকরি বা উচ্চশিক্ষার নিমিত্তে। তাদের বসবাসের একমাত্র ঠিকানা হয় ছাত্রাবাস, হোস্টেল কিংবা মেস। জীবন এখানে প্রতিনিয়ত সংগ্রামের অপর নাম। চাকরি আর পড়াশোনার ধকল সামলে সম্পূর্ণ অপরিচিত কারো সাথে একত্রে থাকতে হয়, রান্না আর ধোয়ামোছার কাজ করতে হয়। অন্ধকার, স্যাঁতস্যাঁতে ছোট ছোট ঘর, কিংবা ছাদের উপর প্রচণ্ড গরমে নোংরা এসব ঘরের ভাড়াও আবার অনেক। ঢাকায় ব্যাচেলর জীবনে এটি অতি সাধারণ চিত্র। আর এ সমস্যার উদ্ভব বাসস্থান সমস্যা থেকেই।

জরিপ অনুযায়ী, ২০০০ সালে বাসস্থানের কমতি ছিল ৫০ লক্ষ। ২০১৯ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৫ লক্ষে। ঢাকার মোট জনসংখ্যা ৩৫ ভাগই থাকে বস্তি অথবা হোস্টেল, মেস কিংবা ছাত্রাবাসের শোচনীয় অনানুষ্ঠানিক বাসাগুলোতে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোরও একই অবস্থা। অনেকের একটি কক্ষ ভাগাভাগি করে নিতে হয়, ছোট একটি বিছানায় দুজনকে শুতে হয়, খেতে হয় নিম্নমানের খাবার।

  • ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী ও পুরুষ মিলিয়ে মোট ১৮টি আবাসিক হল বিদ্যমান।
  • যদিও ঢাকায় মোট মেস বা হোস্টেলের সংখ্যা সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া যায় না, তথাপি ‘বাংলাদেশ মেস অর্গানাইজেশন’ এর তথ্য অনুযায়ী ঢাকায় মোট ১৫ লক্ষ মেস রয়েছে। আজিমপুর, ধানমণ্ডি, লালমাটিয়া, ফার্মগেটের মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোতেই অধিকাংশ মেস এবং হোস্টেল অবস্থিত। এদের মাঝে, ২৫০০’র বেশি ব্যাচেলরের বাসস্থান, দক্ষিণ কমলাপুরের সর্দার কলোনি হলো ঢাকার সবচেয়ে বড় ব্যাচেলর মেস। একেকটি কক্ষে ৫ থেকে ৬ একত্রে বসবাস করেন। মাথাপিছু ভাড়া প্রতিমাসে ১৪০০ থেকে ২৫০০ পর্যন্ত হয়ে থাকে। পানি এবং গ্যাসের বিল মূল ভাড়ায় যুক্ত থাকলেও বিদ্যুৎ বিল ভাড়াটিয়াদের আলাদা করে পরিশোধ করতে হয়। অধিকাংশ মেসেই ব্যাচেলররা নিজেরা রান্না করেন কিংবা কোনো বুয়া ভাড়া করেন। অনেক হোস্টেলে খাবার ব্যবস্থা থাকলেও খাদ্যের মান অত্যন্ত বাজে হওয়ায় ব্যাচেলরদের নিজেদেরই রান্না করতে হয়।

একদিকে যেমন চাহিদা ও যোগানের পার্থক্য বেড়ে চলেছে, অন্যদিকে সরকারের বাসস্থান যোগানের সক্ষমতা মাত্র ৭ শতাংশে নেমে এসেছে যেখানে প্রাইভেট সেক্টরই প্রয়োজনীয় বাসস্থানের ৯৩ ভাগ চাহিদা মেটাচ্ছে। প্রাইভেট বাসস্থান খাতটিকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়।

ক) অনানুষ্ঠানিক বাসাবাড়ি (হোস্টেল, মেস, ছাত্রাবাস) প্রাইভেট সেক্টরের মোট ৫৫ শতাংশ।
খ) প্রাইভেট সেক্টরের ৪৫ শতাংশ বাসাবাড়ির যোগান আসে রিয়েল এস্টেট থেকে।

দ্রুত নগরায়ন, অধিক জনসংখ্যা আর অপরিকল্পিত গৃহায়নের কারণে আজ ব্যাচেলরদের নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। গুলশানে সন্ত্রাসী হামলা আর কল্যাণপুরে জঙ্গি হামলার পর পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। বাড়ির মালিকেরা এসব ঘটনায় ভীত হয়ে পড়েছেন এবং তারা বিশ্বাসহীনতায় ভুগছেন। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ শহরের ৬০টি ব্লকে অভিযান চালায় এবং ব্যাচেলরদের ব্যাপক হয়রানি করতে। এতে করে বাড়িওয়ালারাও নিজেদের বাসায় ব্যাচেলর ভাড়া দিতে চাইছেন না। এসব সমস্যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে সেই পর্যাপ্ত বাসস্থান সমস্যাই।
উপরোক্ত সমস্যাগুলো ছাড়াও ব্যাচেলরদের আরো কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। যেমন-

  • থাকার জায়গা খুঁজে পাবার দুর্ভোগ

  • সদাব্যস্ত ঢাকা শহরে একটি উপযুক্ত বাসস্থান খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। নানাজনকে জিজ্ঞেস করে বেড়ানো, দেয়ালে লিফলেট লাগানো কিংবা শহরের অলিগলিতে টু-লেটের খোঁজে বেরোতে হয় একটি বাসস্থান খুঁজে বের করতে। এর উপর বাড়িওয়ালার সাথে যোগাযোগের জন্য তাদেরকে একাধিক পরিচয়পত্র এবং দলিলের মধ্য দিয়ে যেতে হয়।

  • অপর্যাপ্ত স্থান এবং জনসাধারণের সুযোগ-সুবিধার অভাব

  • ব্যাচেলরদের জন্য বিদ্যমান বাসাগুলো সর্বদাই নোংরা এবং ছোট, যেগুলোতে পর্যাপ্ত আলোবাতাসও প্রবেশ করে না। বাতাস প্রবেশ ছাড়াও নানাপ্রকার পোকামাকড়ের উপদ্রব এবং ছারপোকা ব্যাচেলর বাসাগুলোর সবচেয়ে বড় সমস্যা। কিছু হোস্টেল আর মেসে তো সাধারণ সুযোগ-সুবিধা বলতে কিছুই নেই। পানি ও গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ না থাকা কিংবা ঘনঘন লোড শেডিং তো রয়েছেই।

  • অসংখ্য নিয়মকানুন

  • হোস্টেল কিংবা মেসে থাকতে হলে ব্যাচেলরদের প্রচুর নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। ধরাবাঁধা খাবার সময়, গ্যাস ও বিদ্যুতের সীমাবদ্ধ ব্যবহার, নারী হোস্টেলে কোনো পুরুষ অতিথি কিংবা পুরুষ হোস্টেলে নারী অতিথির আগমন নিষিদ্ধ, অসময়ে গেট বন্ধ করে দেয়া, ইত্যাদি সমস্যা ব্যাচেলরদের জীবনমান নীচে নামিয়ে দেয়।

  • নিরাপত্তার অভাব

  • নিরাপত্তার অভাব অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীদের বাসস্থানে দেখা যায়। যেসব স্থানে নারীদের এই হোস্টেলগুলো অবস্থিত, সেসব খুব একটা নিরাপদ নয়। একক মা কিংবা ডিভোর্স হওয়া নারীদের জন্য এটি আরো বড় সমস্যা। তাছাড়া, একত্রে ঘর ভাগাভাগি করতে থাকতে গিয়ে অনেকের অনেক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র চুরি হয়ে যায়। যথেষ্ট নজরদারির অভাবে এসব ঘটনা ঘটে।

  • জরুরি পরিস্থিতিতে বাড়ি খালি করা

  • ব্যাচেলর জীবন সহজ নয়। থাকার স্থান খুঁজে পাওয়া যেমন কষ্টসাধ্য, বাসস্থান খুঁজে পাবার পরও নিশ্চিন্তে থাকা যায় না। কারণ, যেকোনো সময় জরুরি বাসা ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ আসতে পারে। ফলে, একজন ব্যাচেলরকে পুনরায় বাসা খোঁজার ঝামেলার মাঝে পড়তে হয়।

পর্যাপ্ত অবকাঠামো এবং পরিকল্পিত নগরায়নের অভাবে শহুরে ব্যাচেলররা নিম্নমানের জীবন কাটাচ্ছে। তাই, সরকারকে এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে এবং সকলের জন্য বাসস্থান নির্মাণের পরিকল্পনা করতে হবে। সরকারের ইতোমধ্যে নেয়া কিছু পদক্ষেপ-

  • সরকারের ‘ভিশন ২০২১’ প্রকল্পে ‘সবার জন্য বাসস্থান’কে গুরুত্বের সাথে দেখা হচ্ছে।
  • টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ১১টি লক্ষ্যের মধ্যে ২০৩০ সালের মাঝে সবার জন্য নিরাপদ ও সাশ্রয়ী বাসস্থান সরবরাহের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার।

সরকার যেহেতু এই সমস্যায় খুব বেশিকিছু করতে পারছে না, তাই ব্যাচেলররাই নিজেদের অধিকার রক্ষায় এবং তাদের প্রতি করা বৈষম্যের প্রতিবাদে আওয়াজ তুলতে শুরু করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাচেলরদের হয়রানির প্রতিবাদে গত ১৫ আগস্ট ভাড়াটিয়ারা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে প্রতিবাদ কর্মসূচী পালন করে। ভাড়াটিয়াদের সংগঠন, ‘ভাড়াটিয়া পরিষদ’ ব্যানারে তারা এ প্রতিবাদ কর্মসূচী পালন করে। ব্যাচেলরদের নিরাপদ এবং আবাসযোগ্য বাসস্থান সরবরাহ সহ তারা চারদফা দাবি পেশ করেন।

র‍্যালিতে অংশ নেয়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী একরামুল ইসলাম বলেন, “আমরা আমাদের কর্মসূচীর মাধ্যমে বাড়িওয়ালা, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলবো। মনে হচ্ছে যেন তারা কেউ কোনোকালে ব্যাচেলর কিংবা ছাত্র ছিলেন না। কেউ আমাদের সমস্যা এবং ভোগান্তিগুলো উপলব্ধি করতে পারছে না।” স্বল্প খরচে এবং সাশ্রয়ী বাসস্থান নির্মাণের কোনো ব্যবস্থা বা পরিকল্পনা নেই। কৃষি জমি এবং প্রাকৃতিক জলাশয় রক্ষায় সরকারি পদক্ষেপের অভাব পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে করছে।

এ অবস্থায়, সরকারের উচিত গৃহায়ন খাতে আরো বেশি বেশি ব্যক্তিগত বিনিয়োগ উৎসাহিত করা। আর নতুন নতুন কর্মপরিকল্পনা এবং লোকবল নিয়োগের মাধ্যমে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে হবে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রাবাস নির্মাণ এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর মানোন্নয়ন এক্ষেত্রে বেশ খানিক অগ্রগতি হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে।

যথাযথ ব্যবস্থাপনা এবং বিকেন্দ্রীকরণ করা না হলে এমন এক সময় আসবে, যখন মানুষের রাস্তায় বসবাস করতে হবে। মেগাসিটি ঢাকা নানাবিধ গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন এবং অগ্রগতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, পর্যাপ্ত বাসস্থানের অভাব, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের বাসস্থান সমস্যা এই অগ্রগতিকে রুখে দিতে পারে। তাই, উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, ১২টি সিটি কর্পোরেশন এবং ৩২৮টি পৌরসভার সম্মিলিত উদ্যোগের এটিই সর্বোত্তম সময়। তরুণ প্রজন্ম যদি প্রাত্যহিক জীবনে এভাবে ভোগান্তির শিকার হয়, তাহলে একটি দেশ কিছুতেই এগিয়ে যেতে পারবে না।

কৌতূহলোদ্দীপক প্রাসঙ্গিক বিষয়

পরিবার থেকে একাকী চলে আসা ২৮ বছর বয়সী নারী জেবা আহমেদ বলেন, “আমি একটি মধ্যবিত্ত কিন্ত যথেষ্ট স্বচ্ছল পরিবারে বড় হয়েছি। কিন্তু, এখন আমার ভাইয়ের সংসার বড় হচ্ছে বিধায় আমাকে পরিবার ছেড়ে চলে আসতে হতো। কিন্তু, সামান্য উপার্জন দিয়ে আমার পক্ষে একটি সম্পূর্ণ বাসা ভাড়া নেয়া সম্ভব নয়।” এ প্রসঙ্গে জেবা আরো বলেন, “অবিবাহিতদের জন্য এ শহরে একাকী বসবাস অত্যন্ত কঠিন। প্রথমত, মেসগুলোর অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় এবং ভাড়াও অনেক বেশি। তাছাড়া একটি বাসা ভাড়া করতে হলে অনেকগুলো বিষয় দেখতে হয়, যেমন- ভালো সঙ্গী খুঁজে পাওয়া, নিরাপদ পরিবেশ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, সবকিছু ঠিকঠাক হবার পরও বাড়িওয়ালা বাসা ভাড়া দেবে কিনা সে বিষয়টি।”

বিহারি ক্যাম্পে বসবাসরত আরেক খণ্ডকালীন গৃহপরিচারিকা সায়রুন বেগম বলেন, “আমি দিনের বেলা তিনটি বাসায় কাজ করি এবং সন্ধ্যায় একটি মসজিদের মেঝে পরিষ্কার করি। তাতে আমি মাসে ৫ হাজার টাকা আয় করতে পারি। আমি এই ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার একটি ছোট ঘরে আমার স্বামী এবং ২ ছেলে নিয়ে বসবাস করি। এই ঘরের ভাড়া ৩ হাজার টাকা। ফলে সন্তানদের খাওয়ানোর বা স্কুলে পাঠানোর মতো টাকা আমার হাতে থাকে না। আমাদের মতো গরীব মানুষের জন্য এই ভাড়া অনেক বেশি। কিন্তু আমাদের কোনো বিকল্পও নেই।”

0/Post a Comment/Comments

Previous Post Next Post